ইষ্টানন্দ মহারাজ
-
ডঃঅনিরুদ্ধবর্মণ
ছোট বয়েস থেকে রামকৃষ্ণ মিশনে
মানুষ হয়েছি। বাবা চেরাপুঞ্জি রামকৃষ্ণ মিশন উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষক ছিলেন। আমরা স্কুল
কোয়াটারে থাকতাম। মহারাজদের দূর থেকে নমস্কার করেছি, অনেককে প্রনামও করেছি কিন্তু মনে কেউ ঠিক সেভাবে যায়গা করে নিতে পারেননি। শ্রদ্ধা
অনেককেই করেছি। তবে আজকে যাঁর কথা বলব তিনি একটু আলাদা।
তখন শৈল শহর তুরাতে, তুরা সরকারী
মহাবিদ্যালয় (তুরা গভরমেন্ট কলেজে) কাজ করতাম। চেরাপুঞ্জি রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজরা
আসতেন দীক্ষা দিতে। সাভাবিকভাবেই ওনাদের দীক্ষিত শিষ্যদের বাড়িতেই থাকতেন। এসে আমাদের
কারুর কোন দিন যোগাযোগ করার চেষ্টাও করননি। বাবা বহু বছর কাজ করেছেন রামকৃষ্ণ মিশনে।
চেরাপুঞ্জিতে থাকার সময় মা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যমণি ছিলেন। কিন্তু কেউ কিছু মনে
রাখার চেষ্টা করেনি বা কোন খোঁজ খবর রাখার চেষ্টাও করেনি। চেরাপুঞ্জির কোন অনুষ্ঠানের
খবরও পেতাম না। এমনিতেই দীক্ষিত নই তার ওপর বিধর্মী। তবু খুব কষ্ট পেতাম, কিন্তু কোন
দিন প্রকাশ করিনি।
তখন মোবাইল ফোনের যুগ শুরু
হয়নি। ল্যান্ড ফোনের যুগ। একদিন একটা ফোন এল। তখন ফোনের আওয়াজ শুনে বুঝতে পারতাম স্থানীয়
ফোন না বাইরের। ফোনের আওয়াজ শুনেই বুঝলাম সেটা স্থানীয়। ফোন ওঠালাম। ওপার থেকে ভেসে
এল এক গম্ভীর স্বর, ‘আমি কি অনিরুদ্ধ বর্মণের সংগে কথা বলতে পারি?’ তুরাতে কেউ আমাকে
এইভাবে সম্বোধন করত না। বর্মণ, বা প্রোফেসর বর্মণ বা অনিরুদ্ধ, বা বর্মণ স্যার, কেউবা
ডাক নামে। সঙ্গে সঙ্গে একটা কোথায় অন্য এক সুরের আওয়াজ পেলাম। ‘আমি চেরাপুঞ্জি রামকৃষ্ণ মিশনের হেডমাস্টার
ও সেক্রেটারি মহারাজ (নামটা অনিবার্য কারনে উহ্য রাখলাম) বলছি’। শুনেই তানপুরার এক
তারে টান পড়ল। একজন কেউ এতবছর পর আমাকে স্বীকৃতি দিতে এসেছে। সময় নষ্ট না করে জিজ্ঞেস
করলাম, ‘মহারাজ, আপনি কোথায় আছেন?’ ‘আমি মেঘাবাবুর বাড়িতে আছি।’ স্বাভাবিকভাবেই মহারাজরা
এসে হয় মেঘাবাবুর বাড়ি নাহলে রাহাবাবুর বাড়িতে এসে থাকতেন।
আমি বললাম, ‘মহারাজ, আপনি ওখানেই
থাকুন, আমি আসছি।’ কথাটা যেন নিজের থেকেই বেরিয়ে এল মুখের থেকে। মাকে বললাম চেরাপুঞ্জির
মহারাজ এসেছেন, নিয়ে আসতে যাচ্ছি। নিজের ওপর প্রবল বিশ্বাস। মেঘাবাবুর বাড়ি গিয়ে প্রথমেই
ওনাকে প্রনাম করলাম। এই কাজটা আমি সধারনত করতামনা । উনি বয়সে আমার সমান বা একটু ছোট
বা বড় হবেন। কিন্তু প্রনাম করার সময় কিছু চিন্তা করতে হয়নি। এমনিতেই করে ফেললাম। বললাম,
‘মহারাজ, চলুন।’ মেঘাবাবু বলে উঠলেন, ‘খাওয়াদাওয়া করে যান!’ মহারাজ বলে উঠলেন, ‘আপনারাতো গাড়ো, আপনাদের বাড়িতে
আমি খাবনা, আমি খাশিয়াদের বাড়িতে খাব।’ এইবলে আমাদের বাড়ি চলে এলেন।
মা, বিপদে পড়লেন। আগে মহারাজরা
আমাদের বাড়িতে প্রায়ই খাওয়া-দাওয়া করতেন। তখন সবকিছুই খেতেন। এতদিন প রএখন কী খাবেন?
মহারাজ ব্যাপারটা বুঝে নিজেই বলে উঠলেন, ‘আমি মুরগীর মাংস ছাড়া সবই খাই।’ চিন্তার কোন যায়গা আর রইলনা। মা মহা আনন্দে রান্না করতে গেলেন।
মার রান্নার প্রশংশা সবাই করতেন। খাবার আগে মহারাজ আমার সঙ্গে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের (MBOSE)
অফিসে গেলেন এবং আমার যেহেতু ওখানে পরিচিতি ছিল ওনার কাজ করতে সুবিধা হোল। গাড়িতে আমাকে বললেন, আমাদের পরের ব্যাচের একটা ছেলে
ছিল নিতাই হাজং নামে, তার বাড়িতে ইতিমধ্যে ঘুরে এসেছেন। আরএকটিছেলেছিল, সিদ্ধার্থ ভট্টাচার্য পোস্টঅফিসে কাজ করত আর একটা মেসে থাকতে। পাহাড়ের
ওপর সেই মেসেও গিয়েছিলেন ওর সঙ্গে দেখা করতে। সিদ্ধার্থ স্কুলে হস্টেলে থাকত। ওর রামকৃষ্ণ
মিশনের ওপর আমাদের থেকে আরও বেশি রাগছিল।
সেবার চেরাপুঞ্জি ফিরে যাবার
পরপ্রায়ই আমায় ফোন করতেন। অনেকটা বন্ধুর মত হয়ে গিয়েছিলাম। একদিন ডনবস্কোর এক ফাদারের
সঙ্গে শিলং গেলাম। রাতে ডনবস্কোর এক গেস্ট হাউসে ছিলাম। রাত দশটার দিকে একটা ফোন। পাহাড়ে
দশটা অনেক রাত। তাছাড়াও শিলং আরও পূর্বদিকে, রাতটা একটু তাড়াতাড়ি হয়। এখানে আমাকে কে
ফোন করবে? মাওতো ফোন নম্বর জানেননা। আমি নিজেও জানিনা। অফিসঘরে ফোন। মহারাজ ফোন করেছেন।
‘আমি এখানে আছি কীকরে জানলেন?’ ‘তোমার মাকে ফোন করেছিলাম বললেন তুমি এক ফাদারের সঙ্গে
শিলং এসেছ। তাই খোঁজ করে ফোন নম্বার জোগাড় করলাম। এত কাছে এসেছ, চেরাপুঞ্জি আসবে না?’
‘মহারাজ, এবার তো হবে না। পরে আরেক বার যাব’ খুব কষ্ট পেলেন বুঝলাম। কিন্তু তখন আমার
উপায়ও কিছু নেই।
একদিন একটা ফোন, এবার শিলং
থেকে। ‘আমাদের ভাইস প্রিন্সিপাল অবসর নিচ্ছেন কয়েক মাসের মধ্যেই, ভাবছিলাম ওনার মত
যোগ্যতা সম্পন্ন আমাদের নিজের লোক কেউ যদি ওনার যায়গায় জয়েন করতে পারতেন ...’ আমি চিন্তায়
পরে গেলাম, কার কথা বলা যায়, এই ভেবে। কারোর কথা তক্ষুনি মনে পরছেনা। মহারাজ ঠিক সেই
সময় বোমটা ফেললেন, ‘ভাবছিলাম তুমি যদি আসতে পার।’ আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। কী বলব ভেবে
পাচ্ছিলাম না। যেখানে একদিন বাবার যায়গায় আমার জয়েন করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আমাকে তখন
কেন জানি মনে হোল সেই পোস্টে নেওয়া হবে না! যেখানে শৈশব আর কৈশোরের সেরা দিনগুলো কাটিয়েছি
যেখানে কাজ করার প্রবল ইচ্ছা ছিল। সেই যায়গায় আবার ফিরে যাব – চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
মহারাজ বললেন, ‘এক্ষুনি চিন্তা নেই। পরে চিন্তা করে জানালেই হবে।’ বাড়িতে তিনটে মানুষ,
তিন জনেরই চোখে জল। সেটা আনন্দেরই অশ্রু। তুরা তখনও ততটা মানিয়ে নিতে পারিনি। চেরাপুঞ্জিও
ভুলতে পারছিনা।
একদিন সত্যি সত্যিই স্কুল থেকে
চিঠই এল। উত্তরতো দিতেইহবে। পরামর্শশুরুকরলাম। কিন্তু যাকেই বলি সেইই বলে ফিরে না যেতে।
ভাতৃপ্রতিম এক বন্ধু বলল, ‘দেখ আমি যেই কলেজে পড়াশুনো করেছি সেই কলেজেই পড়াচ্ছি। ফিরে
যাসনা।’ চেরাপুঞ্জি রামকৃষ্ণ মিশনের এক শিক্ষক অচিন্তদাকে জিজ্ঞেস করলাম। অচিন্তদার
ক্ষুরধার বুদ্ধি। আমাকে বুঝিয়ে বললেন, ‘দ্যাখ, তুমিতো রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজদের চেন।
আজকে এক মহারাজ তোমাকে ভালবাসেন, আগামীকাল আর একজন মহারাজ আসবেন আর সব কিছু পালটে যাবে।
তাছাড়া তুমি একটা কলেজে আছ আর এই পোস্টটা ভাইস প্রিন্সিপালের নয় অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টারের।
তুমি তিন জেলা জুড়ে কাজ করছ আর এখানে কাজের পরিধি শুধু এই স্কুলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
আর তোমার কলেজটাও সরকারী কলেজ। আর এটা আধা সরকারী প্রতিষ্ঠান।’ তাছাড়া এখানে পেনসনও
নেই।
কেউ একজন বলুক, ‘তুই যা’। নাঃ
কেউই বলছেনা। কেউই যখন বলছেনা আর না যাওয়াই
ভাল। অনেক কষ্টে, অনেক সাহস করে মহারাজকে একটা চিঠি লিখলাম। ভারাক্রান্ত মনে লিখলাম
গেলে বেতনের কী সমস্যা হবে, চাকরির কী অসুবিধা হবে। না, কোনটাই মন থেকে লিখছি না। অনেকদিন
পর মহারাজ উত্তর দিলেন। খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। একটাই বাক্য লিখলেন, ‘ধরেই নি আমি তোমার
কাছে কোন প্রস্তাব রাখিনি।’ এরপর মহারাজের সঙ্গে সখ্য বন্ধ হয়ে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন
হয়ে গেল।
কয়েক বছর পর শিলং রামকৃষ্ণ
মিশনের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব। শুনলাম গকুলানান্দ মহারাজ এসেছেন। গকুলানান্দ মহারাজ আমাদের
শিক্ষক ছিলেন। স্কুলের তখন হেডমাস্টার ও সেক্রেটারী। দেখা করতে গেলাম। প্রনাম করে বললাম
‘মহারাজ, আমি অনিরুদ্ধ।’ ‘কে অনিরুদ্ধ?’ স্বাভাবিকভাবেই এত বছর পর মনে থাকার কথা নয়।
বললাম, ‘চেরাপুঞ্জির অজিত বর্মণের ছেলে।’ ‘ও হ্যাঁ, আয়’। কিছুক্ষণ পর আবার ভুলে গেলেন,
‘কার ছেলে বললি?’ ‘অজিত বর্মণের, মহারাজ।’ ‘আয় এবার আমাদের তিনজনকে একসঙ্গে দ্যাখ,
আমি, বর্তমান সেক্রেটারী ও প্রাক্তন সেক্রেটারী আমার ভালবাসার মহারাজ (স্বামী ইষ্টানন্দ
মহারাজ)।’ আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছিনা। মহারাজ বললেন, ‘আমিতো ওকে চেরাপুঞ্জি স্কুলের
টিচার করে নিতে চেয়েছিলাম।’ ‘কেন গেলিনা কেন? কোওয়াটার পেতিস!’ গকুলানন্দ মহারাজ বললেন।
আমি কী বলব বুঝে ওঠার আগেই ইষ্টানন্দ মহারাজ পরিত্রাতা হয়ে এগিয়ে এলেন, ‘ওর অর্থনৈতিক
সমস্যা ছিল তাই জয়েন করতে পারেনি।’ এর পর গকুলানন্দ মহারাজ আমাকে ব্রেকফাস্ট টেবিলে
নিয়ে গেলেন। মহারাজরা একদিকে বসে ব্রেকফাস্ট করছেন আর বাকিরা অন্যদিকে। চেরাপুঞ্জিতে
এই ব্যপারটা ঠিক দেখেছি বলে মনে হয়না। তারপর মহারাজদের ব্রেকফাস্ট একধরনের আর অন্যদের
আরেক ধরনের। আমাকে অন্যদিকেই বসতে হোল কিন্তু মহারাজরা যেই ব্রেক ফাস্ট খাচ্ছিলেন তাই
আমাকে দেওয়া হোল। আসেপাসে সবাই এক ধরনের খাবার খাচ্ছেন আর আমি বেশ উন্নত মানের খাবার
খাচ্ছি। খুব লজ্জা লাগছিল।
যাক মহারাজের সঙ্গে এই শেষ
দেখা। গকুলানন্দ মহারাজের সঙ্গেও। তবে বহু বছর পর গকুলানন্দ মহারাজের সঙ্গে ইমেইলে
যোগাযোগ ছিল বহুদিন। উনি তখন দিল্লিতে। আমাকে অনেকবার দিল্লি যেতে বলেছিলেন এবং ওনার
সঙ্গে থাকার কথাও বলেছিলেন। কিন্তু হটাৎ করেই একদিন মেইল আসা বন্ধ হয়ে গেল। বহুদিন
পর খবর পেলাম উনি আর এই পৃথিবীতে নেই। আমার এক ভালোবাসার লোক কমে গেল। আমার বিয়েতে
আশীর্বাদ করে একটা চিঠি লিখেছিলেন আমার বাবাকে। সেটা এখনো আছে।
হ্যাঁ, সেই ইষ্টানন্দ মহারাজের
কথা হচ্ছিল। উনি যখন চেরাপুঞ্জি মিশনের সেক্রেটারী হন তখন নাকি বলেছিলেন, ‘রামকৃষ্ণমিশনে
Snow Balling Effect নেই। এক মহারাজ যা করেছেন সেখান থেকে শুরু না করে আবার নতুন করে
সবকিছু শুরু করা। উনিই প্রথম মহারাজ যিনি বললেন, ‘স্কুলের আসেপাশের বাচ্চারা আমাদের
স্কুলে ভর্তি নাহয়ে ডনবস্কো স্কুলে কেন যায়? আগে এদের আমদের স্কুলে আনতে হবে।’ চেরাপুঞ্জির
উনিই প্রথম ও আপাতত শেষ মহারাজ, যিনি ডনবস্কো স্কুলের রেকটারের বাড়ি যেতেন আর ডনবস্কো
স্কুলের রেকটার ওনার বাড়ি আসতেন। দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সব সমস্যা দূর হয়ে গেল। কী
জানি কোন অজ্ঞাত কারনে রামকৃষ্ণ মিশন চেরাপুঞ্জিতে উনি আর বেশীদিন থাকতে পারলেন না।
হয়ত তাই নিয়ম। আগে তো সেই নিয়ম ছিল না। একেকজন মহারাজ বহু বছর ধরে থাকতেন। ওনাকে অরুণাচলে
বদলি করে দেওয়া হোল। শিলঙের পর ওনার সঙ্গে আর দেখা হয়নি বা আর কোন খবরও পাইনি!
-০-